বৃহস্পতিবার, ১০ জুন, ২০১০

সিটিজেন অভ্ দ্য ওয়ার্ল্ড: ২

লন্ডনে অস্থায়ীভাবে বাস করতে আসা সুসংস্কৃত এক চৈনিক পরিব্রাজকের জবানিতে লেখা এই চিঠিগুলো, যা লন্ডনের একটি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে এই চিঠিগুলোই ‘দি সিটিজেন অভ্ দি ওয়ার্ল্ড’ নামে পুস্তক আকারে প্রকাশ পায়।

পত্র ১
রাশান কারাভানের মাধ্যমে চীনের পিকিং-এর সেরেমোনিয়াল অ্যাকাডেমির প্রথম প্রেসিডেন্ট ফুম হোয়াম-এর উদ্দেশ্যে মস্কোর অধিবাসী ফিপসিহির কাছে লিয়েন চি আলতাংগি-র প্রেরিত

হৃদয়ের ভার যদি এই কাগজের ওপরে নামিয়ে রাখতে না পারতাম আর আমার মনের মানচিত্র প্রতিদিন যদি তোমাকে পাঠাতে না পারতাম, তাহলে, স্বর্গীয় জ্ঞানের অধিকারী, হে আমার প্রিয় বন্ধু, কী দুঃসহই না হয়ে উঠত এই দুর্লঙ্ঘ্য দূরত্ব আমার কাছে!

প্রতিদিনই আমি একটু একটু করে এখানকার পরিবেশ আর মানুষজনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছি। এমনকি এমন স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছি যে, একসময় হয়ত এখানকার মানুষজনকে - শুরুতে যেমন ভেবেছিলাম - তার চেয়ে সমৃদ্ধ, দানশীল আর অতিথিবৎসল বলে আমার মনে হবে। তাদের আচার-ব্যবহার আর রীতি-নীতিও কিছু কিছু শিখতে শুরু করেছি। আর আমাদের রীতি-নীতি, যা থেকে বিশ্বের অন্য সব জাতি শিষ্টাচারের শিক্ষা নিয়েছে, তার সঙ্গে এদের পার্থক্যের কারণও বুঝতে শুরু করেছি।

রুচির পার্থক্য সত্ত্বেও, অথবা আমার পছন্দ হবে না - এমন একধরনের পূর্বনির্ধারিত ধারণা সত্ত্বেও আমি ভাবতে শুরু করেছি, এখানকার রমণীরা অন্তত সহনীয়। কোনোরকম অপছন্দের ভাব ছাড়াই তাদের বিরক্তিকর নীল চোখের দিকে এখন আমি তাকিয়ে থাকতে পারি, এবং তাদের গজদন্তের-চেয়েও-সাদা দাঁতের সারিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে পারি। ভাবতে শুরু করেছি, সৌন্দর্যের কোনো বিশ্বজনীন মানদণ্ড নেই। আসলে এখানকার মেয়েদের আচার-ব্যবহার এতটাই মুক্ত আর হৃদয়গ্রাহী যে, তাদের অন্তরে-নিহিত সৌন্দর্য তাদের বাহ্যিক সৌন্দর্যের অভাবের ক্ষতি পূরণ করেছে বলে আমার মনে হতে শুরু করেছে। তাদের কালো দাঁত নেই, অথবা বৃদ্ধাঙ্গুলির সমান পায়ের সৌন্দর্য থেকেও তারা বঞ্চিত, তবুও তাদের মন আছে, প্রিয় বন্ধু; আর সে মন মুক্ত, আকর্ষণীয়, অতিথিবৎসল ও হৃদয়গ্রাহী। লন্ডনের রাস্তায় মেয়েদের কাছ থেকে একরাতেই নিশিযাপনের যত আমন্ত্রণ আমি পেয়েছি, পিকিং-এ বারো চন্দ্রমাসেও তা পাইনি।

প্রতি সন্ধ্যায় নিঃসঙ্গ পরিব্রাজন শেষ করে যখন ঘরে ফিরি, তখন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাস্তায় এ ধরনের সুবেশা অতিথিবৎসল রমণীর সঙ্গে আমার দেখা হয়। তারা দামি পোশাক পরে থাকে; আর তাদের মনও তাদের সৌন্দর্যের চেয়ে কম সমৃদ্ধ নয়। তুমি তো জানো, কোনো বিচারেই আমার চেহারা সুন্দর নয়। তবুও তারা আমার এই আটপৌরে চেহারা নিয়ে আপত্তি করে না; আমার চৌকো চেহারা আর চ্যাপ্টা নাক দেখে আমাকে ঘৃণা করে না। তারা বোঝে, আমি এখানে আগন্তুক, আর তারাও যেন এর চেয়ে বেশি কিছু চায় না। এমনকি তাদের সাধ্যমত আমাকে তুষ্ট করার আগ্রহ প্রকাশ করাকেও তারা যেন তাদের কর্তব্য বলেই মনে করে। এদের মধ্যে একজন তো আমাকে প্রায় জোর করেই বগলদাবা করে ফেলে। অন্য একজন এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে এই অতিথিপরায়ণতার অংশ হতে চায়। আর তৃতীয় একজন - সে আরো দয়ালু - দ্রাক্ষারস পান করে আমার মন-মেজাজ চাঙ্গা করে নেবার আমন্ত্রণ জানায়। ইংল্যান্ডে দ্রাক্ষারস শুধু ধনীদের জন্যই সংরক্ষিত, অথচ সেই দ্রাক্ষারসও এখানে আগন্তুকদের পরিবেশন করা হয়।

কয়েকদিন আগে এমনই এক রাতে এই উদারচিত্ত প্রাণীদের একজন - সম্পূর্ণ সাদা পোশাকে আবৃত - উল্কার মত ঝলমল করতে করতে আমার কাছে এসে প্রায় জোর করে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিল। আসবাবপত্র আর বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার জাঁকজমক দেখে সে মুগ্ধ হয়ে গেল বলে আমার মনে হল। অবশ্য মুগ্ধ সে হতেই পারে, কারণ এই ঘরটির জন্য সপ্তাহে দু’শিলিং করে আমাকে ভাড়া গুনতে হয়। কিন্ত এখানেই শেষ নয়; তার সৌজন্য আরো অবশিষ্ট ছিল। যাবার সময় আমার ঘড়িটি দেখে সেটি মেরামত করা প্রয়োজন জেনে সে তার এক আত্মীয়কে দিয়ে সারিয়ে দেবে বলে নিয়ে গেল। বুঝতেই পারছ, এর ফলে আমার বেশ কিছু খরচ বেঁচে যাবে। শুধু তাই নয়, সে আমাকে আশ্বস্ত করে গেল যে, এতে আমার কোনো পয়সা লাগবে না আর কয়েকদিনের মধ্যেই ঘড়িটি আমি ফেরত পেয়ে যাব। ফলে, এখন আমি এ উপলক্ষে একটি কৃতজ্ঞতাভাষণ রচনা করতে শুরু করেছি: “হে স্বর্গের গুণে গুণান্বিতা মহিয়সী, আমি ধন্য, কারণ দীর্ঘ ও কষ্টকর এক অভিযাত্রার পর এমন একটি নিষ্পাপ দেশ আর এমন মানবতাবোধনিষিক্ত মানুষজনের সন্ধান লাভ করতে পেরেছি। এর পর হয়ত এখন-পর্যন্ত-অনাবিষ্কৃত অন্য কোনো দেশ ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে গিয়ে আমি পড়ব, কিন্ত তোমার বক্ষপিঞ্জরে যার অধিষ্ঠান তেমন পবিত্র আত্মা আর কোথায় পাব? নিশ্চয়ই শিন শিন তার চঞ্চু দিয়ে খাইয়ে তোমাকে বড় করেছে, অথবা নিশ্চয়ই তুমি ঐশী জিন হিউং-এর স্তনধারা পান করে বড় হয়েছ। তোমার কণ্ঠসুধা চং ফৌ-এর কাছ থেকে তার শাবককে ছিনিয়ে আনতে পারে, অথবা পারে জলতলবাসী বোহ-কে অন্ধ অনুসারীর মত চালিত করতে। তোমার এই অনুগ্রহের কথা এই ভৃত্য চিরকাল মনে রাখবে এবং একদিন চীনকন্যাদের কাছে তোমার এই অনুগ্রহ, নিষ্ঠা ও সততা নিয়ে গর্ব করবে।”

বিদায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন