পত্র ২
প্রাপক একই ব্যক্তি
আমি প্রতারিত হয়েছি! স্বর্গের কন্যা ভেবে যার উদ্দেশ্যে আমি প্রশস্তি রচনা করেছিলাম, শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সে হ্যান-এর কুখ্যাত শিষ্যাদের একজন! যা আমি হারিয়েছি, তা তুচ্ছই; কিন্তু এর মাধ্যমে একটা ঠগ আবিষ্কারের সান্ত্বনা লাভ করা গেছে। এর ফলে, ইংরেজ নারীদের সম্পর্কে আমার যে নিরাসক্তি ছিল, তার মধ্যে আরো একবার আমি আশ্রয় গ্রহণ করলাম। তাদেরকে আবার আমার কাছে অসুন্দর বলে মনে হতে শুরু করল। এমনি করে আমার সমস্ত সময় কেটে যাচ্ছে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে, যে সিদ্ধান্ত আবার পর-মুহূর্তের একটি অভিজ্ঞতাতেই হয়ত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ‘বর্তমান’ কেবলই ‘অতীতের মন্তব্য’ হয়ে দেখা দিচ্ছে; আর এতে করে আমার প্রজ্ঞার চেয়ে আত্মগ্লানিই বাড়ছে।
এদের আইনে ও ধর্মে একাধিক স্ত্রী রাখা নিষিদ্ধ। ফলে, আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে, এদের সমাজে দেহপসারিনীদের স্থান নেই। ভুল ভেবেছিলাম। যতগুলো স্ত্রী রাখার ক্ষমতা আছে, এখানকার প্রত্যেকটা লোক ততগুলো স্ত্রী রাখে। রক্ত দিয়ে এই আইন তারা প্রতিষ্ঠা করেছে, তার প্রশংসা করেছে এবং তাকে অমান্য করেছে। চীনা ধর্মে দুই স্ত্রী রাখার বিধান থাকলেও এই বিষয়ে তারা ইংরেজদের অর্ধেক স্বাধীনতাও গ্রহণ করে না। সিবিলস-এর রচনাবলির সাথে এদের এই আইনের তুলনা করা যায় - এগুলোর ব্যাপারে মানুষের বিপুল শ্রদ্ধা, কিন্ত পড়ে খুব কম লোকে, বোঝে আরো কম, আর যারা বোঝে বলে দাবি করে তারা এর অর্থ নিয়ে বিভ্রান্তিই বাড়ায় এবং অন্যদের সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা স্বীকার করে। ফলে, একটিমাত্র স্ত্রী রাখার আইন তারাই পালন করে যাদের জন্য একটিই যথেষ্টর চেয়ে বেশি, অথবা একাধিক রাখার সঙ্গতি যাদের নেই। বাকিরা প্রকাশ্যেই এই আইন অমান্য করে। তাদের অনেকেই আবার এই অমান্য করাকেই বাহাদুরি বলে মনে করে। পারস্যবাসীদের মত তারাও হারেমের আকারকেই পৌরুষের নিদর্শন বলে মনে করে। ফলে, এখানে মান্দারিন রাখে চার স্ত্রী, সাধারণ ভদ্রলোক তিন আর মঞ্চাভিনেতা রাখে দুই স্ত্রী। আর ম্যাজিস্ট্রেট, গ্রাম-বিচারক আর জমিদারদের প্রধান কাজ প্রথমে অল্পবয়সী কুমারীদের সাথে ব্যভিচার করা, তারপর ব্যভিচারিণীদের সাজা দেয়া।
এই বর্ণনা থেকে তোমার মনে হয়ত এমন একটি ধারণা জন্মাবে যে, আমোদ-ফুর্তির জন্য যে চার স্ত্রী রাখে, তার শারীরিক সামর্থ্য হয়ত এক-স্ত্রীওয়ালার চারগুণ; কিংবা মান্দারিনরা বোধ হয় সাধারণ ভদ্রলোকদের চেয়ে এবং সাধারণ ভদ্রলোকেরা মঞ্চাভিনেতাদের চেয়ে বেশি পারঙ্গম। কিন্ত বাস্তব চিত্র ঠিক এর বিপরীত। অতিরিক্ত ভোগবিলাসের কারণে মান্দারিনরা প্রায়ই হয় রোগা লিকলিকে। ওদের বৈচিত্র্য প্রয়োজন হয় শারীরিক সামর্থ্যের জন্য নয়, বরং সামর্থ্যের অভাবের জন্য। ফলে, স্ত্রীর সংখ্যাই এখানে তাদের সংশয়াকীর্ণ পৌরুষের লক্ষণ।
গ্রাম্য বিত্তশালীদের বাইরেও আরেক ধরনের লোক আছে, সুন্দরী মেয়েদের সাথে নষ্টামি করাই যাদের কাজ; আর মেয়েরাও যেন এদেরকেই পছন্দ করে। কিছুটা সংবেদনশীল মেয়েরা এদেরকে ‘বিরক্তিকর’ আখ্যায় ভূষিত করে। তুমি নিশ্চয়ই জানতে চাইবে, কী এমন গুণের অধিকারী এরা যার কারণে বিপরীত লিঙ্গের অধিকাংশই এদের প্রতি আকৃষ্ট হয়; অন্যদের তুলনায় রূপে-গুণে কোনদিক থেকে তারা শ্রেষ্ঠতর। তোমাকে সরাসরি বলতে গেলে, সৌন্দর্য বা প্রতিভার কোনোটাই এদের নেই - আছে শুধু নাছোড়বান্দা স্বভাব আর নির্লজ্জতা। এই অধ্যবসায় আর নির্লজ্জতা দিয়ে সব বয়সের সব রকমের চেহারার লোকই ভক্ত জুটিয়ে ফেলতে পারে। এমন লোকের কথাও আমি শুনেছি, বয়সের ভারে যে মরণাপন্ন, সে প্রেমের জন্য প্রাণপাত করছে বলে দাবি করে। তার চেয়েও অবাক ব্যাপার হল এই যে, এই ঘাটের মড়াগুলো এসব কলঙ্কিত বিষয়ে সাধারণত দারুণ সাফল্য লাভ করে থাকে।
এরা প্রতিদিন সকালে তিন ঘণ্টা ব্যয় করে মস্তকবিন্যাসের পেছনে। মস্তকবিন্যাস বলতে অবশ্য এখানে কেশবিন্যাস বুঝতে হবে।
এরা হল পেশাদার চাটুকার - তবে বিশেষ কোনো নারীর নয়, বরং সমগ্র নারীজাতির।
তাকে ধরে নিতে হয়, প্রত্যেক নারীরই প্রতি রাতে ঠাণ্ডা লাগে। কারণ, এর ফলে প্রতিদিন সকালে গিয়ে তাদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাওয়া যায়।
মেয়েদের জন্য সে কতটা কষ্ট করতে পারে, সেটা প্রদর্শনের জন্য সবসময়ই তাকে তৎপর থাকতে হয়। একটা পিন পড়ে গেলেও সেটা তুলে দেবার জন্য সে প্রায় উড়ে আসে।
মেয়েদের কানের কাছে মুখ না নিয়ে সে তাদের সাথে কথাই বলতে পারে না। আর এটা করতে গিয়ে প্রায়শই সে একাধিক ইন্দ্রিয়ের সহায়তা গ্রহণ করে।
প্রয়োজনবোধে সে খুবই নমনীয় ও কোমল রূপ ধারণ করতে পারে। বুকে হাত রেখে, চোখ বন্ধ করে, গদগদ ভঙ্গিতে দাঁত বার করে এই ভাবটি সে ফুটিয়ে তোলে।
মেয়েদের সাথে মিনুয়েট নাচ নাচতে তার আগ্রহের কমতি নেই। এই নাচ মানে ভারিক্কি ভাব ধরে হ্যাট হাতে নিয়ে ঘরময় আট-দশবার চক্কর দেয়া আর মাঝে মাঝে সঙ্গিনীর দিকে সুকোমল দৃষ্টি নিক্ষেপ করা।
সে কখনোই কাউকে অপমান করে না, অথবা অন্য কেউ তাকে অপমান করলেও সে তা গায়ে মাখে না।
তার কাছে সব ধরনের পরিস্থিতির উপযোগী চুটকি মজুত থাকে। আর যখন তার বলার মত আর কিছুই থাকে না, তখন সে হাসতে থাকে।
মেয়েদেরকে নষ্ট করতে না পারা পর্যন্ত এই শিকারীরা নিজেদেরকেই টোপের মত করে মেয়েদের সামনে ন্যস্ত করে রাখে। যাবতীয় ভদ্র আচরণ ও কোমল ব্যবহার এদের দুরভিসন্ধিরই পুঁজি। মেয়েদের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে আর তাদের তোষামোদ করতে করতে তারা নিজেরাই অনেকখানি মেয়েলি হয়ে যায়।