বৃহস্পতিবার, ১০ জুন, ২০১০

সিটিজেন অভ্ দ্য ওয়ার্ল্ড: ৩

পত্র ২


প্রাপক একই ব্যক্তি


আমি প্রতারিত হয়েছি! স্বর্গের কন্যা ভেবে যার উদ্দেশ্যে আমি প্রশস্তি রচনা করেছিলাম, শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সে হ্যান-এর কুখ্যাত শিষ্যাদের একজন! যা আমি হারিয়েছি, তা তুচ্ছই; কিন্তু এর মাধ্যমে একটা ঠগ আবিষ্কারের সান্ত্বনা লাভ করা গেছে। এর ফলে, ইংরেজ নারীদের সম্পর্কে আমার যে নিরাসক্তি ছিল, তার মধ্যে আরো একবার আমি আশ্রয় গ্রহণ করলাম। তাদেরকে আবার আমার কাছে অসুন্দর বলে মনে হতে শুরু করল। এমনি করে আমার সমস্ত সময় কেটে যাচ্ছে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে, যে সিদ্ধান্ত আবার পর-মুহূর্তের একটি অভিজ্ঞতাতেই হয়ত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান কেবলই অতীতের মন্তব্য হয়ে দেখা দিচ্ছে; আর এতে করে আমার প্রজ্ঞার চেয়ে আত্মগ্লানিই বাড়ছে।


এদের আইনে ও ধর্মে একাধিক স্ত্রী রাখা নিষিদ্ধ। ফলে, আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে, এদের সমাজে দেহপসারিনীদের স্থান নেই। ভুল ভেবেছিলাম। যতগুলো স্ত্রী রাখার ক্ষমতা আছে, এখানকার প্রত্যেকটা লোক ততগুলো স্ত্রী রাখে। রক্ত দিয়ে এই আইন তারা প্রতিষ্ঠা করেছে, তার প্রশংসা করেছে এবং তাকে অমান্য করেছে। চীনা ধর্মে দুই স্ত্রী রাখার বিধান থাকলেও এই বিষয়ে তারা ইংরেজদের অর্ধেক স্বাধীনতাও গ্রহণ করে না। সিবিলস-এর রচনাবলির সাথে এদের এই আইনের তুলনা করা যায় - এগুলোর ব্যাপারে মানুষের বিপুল শ্রদ্ধা, কিন্ত পড়ে খুব কম লোকে, বোঝে আরো কম, আর যারা বোঝে বলে দাবি করে তারা এর অর্থ নিয়ে বিভ্রান্তিই বাড়ায় এবং অন্যদের সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা স্বীকার করে। ফলে, একটিমাত্র স্ত্রী রাখার আইন তারাই পালন করে যাদের জন্য একটিই যথেষ্টর চেয়ে বেশি, অথবা একাধিক রাখার সঙ্গতি যাদের নেই। বাকিরা প্রকাশ্যেই এই আইন অমান্য করে। তাদের অনেকেই আবার এই অমান্য করাকেই বাহাদুরি বলে মনে করে। পারস্যবাসীদের মত তারাও হারেমের আকারকেই পৌরুষের নিদর্শন বলে মনে করে। ফলে, এখানে মান্দারিন রাখে চার স্ত্রী, সাধারণ ভদ্রলোক তিন আর মঞ্চাভিনেতা রাখে দুই স্ত্রী। আর ম্যাজিস্ট্রেট, গ্রাম-বিচারক আর জমিদারদের প্রধান কাজ প্রথমে অল্পবয়সী কুমারীদের সাথে ব্যভিচার করা, তারপর ব্যভিচারিণীদের সাজা দেয়া।


এই বর্ণনা থেকে তোমার মনে হয়ত এমন একটি ধারণা জন্মাবে যে, আমোদ-ফুর্তির জন্য যে চার স্ত্রী রাখে, তার শারীরিক সামর্থ্য হয়ত এক-স্ত্রীওয়ালার চারগুণ; কিংবা মান্দারিনরা বোধ হয় সাধারণ ভদ্রলোকদের চেয়ে এবং সাধারণ ভদ্রলোকেরা মঞ্চাভিনেতাদের চেয়ে বেশি পারঙ্গম। কিন্ত বাস্তব চিত্র ঠিক এর বিপরীত। অতিরিক্ত ভোগবিলাসের কারণে মান্দারিনরা প্রায়ই হয় রোগা লিকলিকে। ওদের বৈচিত্র্য প্রয়োজন হয় শারীরিক সামর্থ্যের জন্য নয়, বরং সামর্থ্যের অভাবের জন্য। ফলে, স্ত্রীর সংখ্যাই এখানে তাদের সংশয়াকীর্ণ পৌরুষের লক্ষণ।


গ্রাম্য বিত্তশালীদের বাইরেও আরেক ধরনের লোক আছে, সুন্দরী মেয়েদের সাথে নষ্টামি করাই যাদের কাজ; আর মেয়েরাও যেন এদেরকেই পছন্দ করে। কিছুটা সংবেদনশীল মেয়েরা এদেরকে বিরক্তিকর আখ্যায় ভূষিত করে। তুমি নিশ্চয়ই জানতে চাইবে, কী এমন গুণের অধিকারী এরা যার কারণে বিপরীত লিঙ্গের অধিকাংশই এদের প্রতি আকৃষ্ট হয়; অন্যদের তুলনায় রূপে-গুণে কোনদিক থেকে তারা শ্রেষ্ঠতর। তোমাকে সরাসরি বলতে গেলে, সৌন্দর্য বা প্রতিভার কোনোটাই এদের নেই - আছে শুধু নাছোড়বান্দা স্বভাব আর নির্লজ্জতা। এই অধ্যবসায় আর নির্লজ্জতা দিয়ে সব বয়সের সব রকমের চেহারার লোকই ভক্ত জুটিয়ে ফেলতে পারে। এমন লোকের কথাও আমি শুনেছি, বয়সের ভারে যে মরণাপন্ন, সে প্রেমের জন্য প্রাণপাত করছে বলে দাবি করে। তার চেয়েও অবাক ব্যাপার হল এই যে, এই ঘাটের মড়াগুলো এসব কলঙ্কিত বিষয়ে সাধারণত দারুণ সাফল্য লাভ করে থাকে।


এরা প্রতিদিন সকালে তিন ঘণ্টা ব্যয় করে মস্তকবিন্যাসের পেছনে। মস্তকবিন্যাস বলতে অবশ্য এখানে কেশবিন্যাস বুঝতে হবে।


এরা হল পেশাদার চাটুকার - তবে বিশেষ কোনো নারীর নয়, বরং সমগ্র নারীজাতির।


তাকে ধরে নিতে হয়, প্রত্যেক নারীরই প্রতি রাতে ঠাণ্ডা লাগে। কারণ, এর ফলে প্রতিদিন সকালে গিয়ে তাদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাওয়া যায়।


মেয়েদের জন্য সে কতটা কষ্ট করতে পারে, সেটা প্রদর্শনের জন্য সবসময়ই তাকে তৎপর থাকতে হয়। একটা পিন পড়ে গেলেও সেটা তুলে দেবার জন্য সে প্রায় উড়ে আসে।


মেয়েদের কানের কাছে মুখ না নিয়ে সে তাদের সাথে কথাই বলতে পারে না। আর এটা করতে গিয়ে প্রায়শই সে একাধিক ইন্দ্রিয়ের সহায়তা গ্রহণ করে।


প্রয়োজনবোধে সে খুবই নমনীয় ও কোমল রূপ ধারণ করতে পারে। বুকে হাত রেখে, চোখ বন্ধ করে, গদগদ ভঙ্গিতে দাঁত বার করে এই ভাবটি সে ফুটিয়ে তোলে।


মেয়েদের সাথে মিনুয়েট নাচ নাচতে তার আগ্রহের কমতি নেই। এই নাচ মানে ভারিক্কি ভাব ধরে হ্যাট হাতে নিয়ে ঘরময় আট-দশবার চক্কর দেয়া আর মাঝে মাঝে সঙ্গিনীর দিকে সুকোমল দৃষ্টি নিক্ষেপ করা।


সে কখনোই কাউকে অপমান করে না, অথবা অন্য কেউ তাকে অপমান করলেও সে তা গায়ে মাখে না।


তার কাছে সব ধরনের পরিস্থিতির উপযোগী চুটকি মজুত থাকে। আর যখন তার বলার মত আর কিছুই থাকে না, তখন সে হাসতে থাকে।


মেয়েদেরকে নষ্ট করতে না পারা পর্যন্ত এই শিকারীরা নিজেদেরকেই টোপের মত করে মেয়েদের সামনে ন্যস্ত করে রাখে। যাবতীয় ভদ্র আচরণ ও কোমল ব্যবহার এদের দুরভিসন্ধিরই পুঁজি। মেয়েদের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে আর তাদের তোষামোদ করতে করতে তারা নিজেরাই অনেকখানি মেয়েলি হয়ে যায়।


সিটিজেন অভ্ দ্য ওয়ার্ল্ড: ২

লন্ডনে অস্থায়ীভাবে বাস করতে আসা সুসংস্কৃত এক চৈনিক পরিব্রাজকের জবানিতে লেখা এই চিঠিগুলো, যা লন্ডনের একটি পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে এই চিঠিগুলোই ‘দি সিটিজেন অভ্ দি ওয়ার্ল্ড’ নামে পুস্তক আকারে প্রকাশ পায়।

পত্র ১
রাশান কারাভানের মাধ্যমে চীনের পিকিং-এর সেরেমোনিয়াল অ্যাকাডেমির প্রথম প্রেসিডেন্ট ফুম হোয়াম-এর উদ্দেশ্যে মস্কোর অধিবাসী ফিপসিহির কাছে লিয়েন চি আলতাংগি-র প্রেরিত

হৃদয়ের ভার যদি এই কাগজের ওপরে নামিয়ে রাখতে না পারতাম আর আমার মনের মানচিত্র প্রতিদিন যদি তোমাকে পাঠাতে না পারতাম, তাহলে, স্বর্গীয় জ্ঞানের অধিকারী, হে আমার প্রিয় বন্ধু, কী দুঃসহই না হয়ে উঠত এই দুর্লঙ্ঘ্য দূরত্ব আমার কাছে!

প্রতিদিনই আমি একটু একটু করে এখানকার পরিবেশ আর মানুষজনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছি। এমনকি এমন স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছি যে, একসময় হয়ত এখানকার মানুষজনকে - শুরুতে যেমন ভেবেছিলাম - তার চেয়ে সমৃদ্ধ, দানশীল আর অতিথিবৎসল বলে আমার মনে হবে। তাদের আচার-ব্যবহার আর রীতি-নীতিও কিছু কিছু শিখতে শুরু করেছি। আর আমাদের রীতি-নীতি, যা থেকে বিশ্বের অন্য সব জাতি শিষ্টাচারের শিক্ষা নিয়েছে, তার সঙ্গে এদের পার্থক্যের কারণও বুঝতে শুরু করেছি।

রুচির পার্থক্য সত্ত্বেও, অথবা আমার পছন্দ হবে না - এমন একধরনের পূর্বনির্ধারিত ধারণা সত্ত্বেও আমি ভাবতে শুরু করেছি, এখানকার রমণীরা অন্তত সহনীয়। কোনোরকম অপছন্দের ভাব ছাড়াই তাদের বিরক্তিকর নীল চোখের দিকে এখন আমি তাকিয়ে থাকতে পারি, এবং তাদের গজদন্তের-চেয়েও-সাদা দাঁতের সারিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে পারি। ভাবতে শুরু করেছি, সৌন্দর্যের কোনো বিশ্বজনীন মানদণ্ড নেই। আসলে এখানকার মেয়েদের আচার-ব্যবহার এতটাই মুক্ত আর হৃদয়গ্রাহী যে, তাদের অন্তরে-নিহিত সৌন্দর্য তাদের বাহ্যিক সৌন্দর্যের অভাবের ক্ষতি পূরণ করেছে বলে আমার মনে হতে শুরু করেছে। তাদের কালো দাঁত নেই, অথবা বৃদ্ধাঙ্গুলির সমান পায়ের সৌন্দর্য থেকেও তারা বঞ্চিত, তবুও তাদের মন আছে, প্রিয় বন্ধু; আর সে মন মুক্ত, আকর্ষণীয়, অতিথিবৎসল ও হৃদয়গ্রাহী। লন্ডনের রাস্তায় মেয়েদের কাছ থেকে একরাতেই নিশিযাপনের যত আমন্ত্রণ আমি পেয়েছি, পিকিং-এ বারো চন্দ্রমাসেও তা পাইনি।

প্রতি সন্ধ্যায় নিঃসঙ্গ পরিব্রাজন শেষ করে যখন ঘরে ফিরি, তখন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাস্তায় এ ধরনের সুবেশা অতিথিবৎসল রমণীর সঙ্গে আমার দেখা হয়। তারা দামি পোশাক পরে থাকে; আর তাদের মনও তাদের সৌন্দর্যের চেয়ে কম সমৃদ্ধ নয়। তুমি তো জানো, কোনো বিচারেই আমার চেহারা সুন্দর নয়। তবুও তারা আমার এই আটপৌরে চেহারা নিয়ে আপত্তি করে না; আমার চৌকো চেহারা আর চ্যাপ্টা নাক দেখে আমাকে ঘৃণা করে না। তারা বোঝে, আমি এখানে আগন্তুক, আর তারাও যেন এর চেয়ে বেশি কিছু চায় না। এমনকি তাদের সাধ্যমত আমাকে তুষ্ট করার আগ্রহ প্রকাশ করাকেও তারা যেন তাদের কর্তব্য বলেই মনে করে। এদের মধ্যে একজন তো আমাকে প্রায় জোর করেই বগলদাবা করে ফেলে। অন্য একজন এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে এই অতিথিপরায়ণতার অংশ হতে চায়। আর তৃতীয় একজন - সে আরো দয়ালু - দ্রাক্ষারস পান করে আমার মন-মেজাজ চাঙ্গা করে নেবার আমন্ত্রণ জানায়। ইংল্যান্ডে দ্রাক্ষারস শুধু ধনীদের জন্যই সংরক্ষিত, অথচ সেই দ্রাক্ষারসও এখানে আগন্তুকদের পরিবেশন করা হয়।

কয়েকদিন আগে এমনই এক রাতে এই উদারচিত্ত প্রাণীদের একজন - সম্পূর্ণ সাদা পোশাকে আবৃত - উল্কার মত ঝলমল করতে করতে আমার কাছে এসে প্রায় জোর করে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিল। আসবাবপত্র আর বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার জাঁকজমক দেখে সে মুগ্ধ হয়ে গেল বলে আমার মনে হল। অবশ্য মুগ্ধ সে হতেই পারে, কারণ এই ঘরটির জন্য সপ্তাহে দু’শিলিং করে আমাকে ভাড়া গুনতে হয়। কিন্ত এখানেই শেষ নয়; তার সৌজন্য আরো অবশিষ্ট ছিল। যাবার সময় আমার ঘড়িটি দেখে সেটি মেরামত করা প্রয়োজন জেনে সে তার এক আত্মীয়কে দিয়ে সারিয়ে দেবে বলে নিয়ে গেল। বুঝতেই পারছ, এর ফলে আমার বেশ কিছু খরচ বেঁচে যাবে। শুধু তাই নয়, সে আমাকে আশ্বস্ত করে গেল যে, এতে আমার কোনো পয়সা লাগবে না আর কয়েকদিনের মধ্যেই ঘড়িটি আমি ফেরত পেয়ে যাব। ফলে, এখন আমি এ উপলক্ষে একটি কৃতজ্ঞতাভাষণ রচনা করতে শুরু করেছি: “হে স্বর্গের গুণে গুণান্বিতা মহিয়সী, আমি ধন্য, কারণ দীর্ঘ ও কষ্টকর এক অভিযাত্রার পর এমন একটি নিষ্পাপ দেশ আর এমন মানবতাবোধনিষিক্ত মানুষজনের সন্ধান লাভ করতে পেরেছি। এর পর হয়ত এখন-পর্যন্ত-অনাবিষ্কৃত অন্য কোনো দেশ ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে গিয়ে আমি পড়ব, কিন্ত তোমার বক্ষপিঞ্জরে যার অধিষ্ঠান তেমন পবিত্র আত্মা আর কোথায় পাব? নিশ্চয়ই শিন শিন তার চঞ্চু দিয়ে খাইয়ে তোমাকে বড় করেছে, অথবা নিশ্চয়ই তুমি ঐশী জিন হিউং-এর স্তনধারা পান করে বড় হয়েছ। তোমার কণ্ঠসুধা চং ফৌ-এর কাছ থেকে তার শাবককে ছিনিয়ে আনতে পারে, অথবা পারে জলতলবাসী বোহ-কে অন্ধ অনুসারীর মত চালিত করতে। তোমার এই অনুগ্রহের কথা এই ভৃত্য চিরকাল মনে রাখবে এবং একদিন চীনকন্যাদের কাছে তোমার এই অনুগ্রহ, নিষ্ঠা ও সততা নিয়ে গর্ব করবে।”

বিদায়।